হাতুড়ি মাথা
গ্রীষ্মপ্রধান বনাঞ্চলের উষ্ণ ও আর্দ্র মাটিতে পাওয়া বিভিন্ন ধরনের স্থলজ ‘ট্রাইক্লাড প্লানারিয়ানদের’ মধ্যে সবচেয়ে বড়টি হলো বাইপেলিয়াম। মাস কয়েক পূর্বে সকাল বেলায় সামান্য বৃষ্টির পর রাজশাহীর পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে রাস্তায় হাঁটার সময় রাস্তার পাশের তৃণভূমি থেকে বেরিয়ে আসা একটি হাতুড়ি মাথা কীট চোখে পড়ে। এ প্রজাতিটিই হলো কৃষকবন্ধু, প্রকৃতির লাঙ্গল কেঁচো শিকারি বাইপেলিয়াম।যেকোন কেঁচো চাষি, ও কৃষকের জন্য আতঙ্কের কীট বাইপেলিয়াম। এটি প্রাণিজগতের ‘প্লাটিহেলমিনথেস’ পর্বের ‘টারবেলারিয়া’ শ্রেণী, ‘ট্রাইক্লাডিডা’ বর্গ ও ‘বাইপেলিডি’ গোত্রের অন্তর্গত একটি প্রজাতি।
হাইড্রার মতই বাইপেলিয়াম তার খন্ডিত দেহ থেকে দ্রুত বংশবিস্তার করতে পারে। দিনের মধ্যেই এরা একটি কেঁচো খামারের সকল কেঁচো খেয়ে ফেলতে সক্ষম। ১৮৭৮ সালে লন্ডনের নিকটবর্তী কিউ বোটানিক্যাল গার্ডেনের গ্রীণ হাউজে বাইপেলিয়াম কিউইনজি প্রজাতিটি প্রথম শনাক্ত করা হয়।
দিনের বেলায় এ-প্লানারিয়ানগুলো আলোর বিপরীতে অবস্থান নেয়। তাদের স্বাভাবিক জীবন পরিচালনায় প্রয়োজন উচ্চ-আর্দ্রতাবিশিষ্ট জলবায়ু। আর তাই উচ্চ-আর্দ্রতাবিশিষ্ট দিন যেমন বৃষ্টির দিনেই এদের উপস্থিতি থাকে বেশি। অধিক বৃষ্টিপাতের পর কোনো পাথর, কাঠের গুঁড়ি, ঝোপ-ঝাড়, আবর্জনা বা ভূপৃষ্ঠের ঠিক নিচেই এদের বিচরণ দেখা যায়। তবে শুষ্ক মৌমুমেও প্রাণীটি দেহের ওজনের ৪৫ শতাংশের অধিক পরিমাণ পানি না হারানো পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। তবে বসন্ত ও বর্ষায় এধরনের স্থলজ প্লানারিয়ানদের আধিক্য ঘটে।
বাইপেলিয়াম প্রাণীটির দেহের ব্যাস কেঁচোর দেহের মতোই। তবে এরা গড়ে ১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এদের দেহ নরম, দ্বিপার্শ্বীয় প্রতিসম, সিলোম বিহীন, অঙ্কীয়-পৃষ্ঠীয়ভাবে চ্যাপ্টা। মাথাটি দেহের চেয়ে প্রশস্ত ও দেহের সঙ্গে সংযুক্ত অবস্থায় অনেকটা হাতুড়ির মত মনে হয়। দেহ সর্বদা প্যাঁচানো অবস্থায় থাকে। এদের মাথায় ও দেহপার্শ্বে অনেকগুলো চক্ষুবিন্দু রয়েছে। কাঁধের নিকট বেগুনি, কালো, হলুদ, জলপাই বা বাদামি বর্ণের ডোরা থাকে। দেহের অঙ্কীয় দিকে মধ্য বরাবর লম্বালম্বিভাবে থাকে ক্রিপিং সোল, যা দিয়ে এরা হামাগুড়ি দিতে সক্ষম হয়। এদের কোনো শ্বসন বা পরিবহন তন্ত্র নেই। নেই কোনো কঙ্কাল কিংবা পায়ুপথ। দেহের মাঝামাঝি অঙ্কীয় দিকে অবস্থিত একটি মুখছিদ্রই এদের মুখ ও পায়ুর কাজ করে। এদের অন্ত্র তিনটি শাখায় বিভক্ত। দেহে বৃত্তাকার ও আনুদৈর্ঘ্যিক পেশী বিন্যাস লক্ষ্যনীয়। সেরেব্রাল গ্যাংগ্লিয়নটি মস্তিষ্কের কাজ করে। স্নায়ুতন্ত্রটি মই আকৃতির। আর রেচনকার্য সম্পাদিত হয় প্রোটিনেফ্রিডিয়াল তন্ত্রের মাধ্যমে।
বাইপেলিয়ামের প্রধান খাবারের তালিকায় রয়েছে কেঁচো, মোলাস্কান স্লাগ (খোলক বিহীন শামুক জাতীয় প্রাণী), পতঙ্গের লার্ভা, এমনকি নিজ প্রজাতির অন্য সদস্য। এরা সাধারণত রাতের বেলা খাবার গ্রহণ করে। মাথার নিচে বা সিলিয়াযুক্ত অঙ্কীয় খাঁজের মাঝে থাকা কোমো-রিসেপ্টরের সাহায্যে এরা শিকারের সন্ধান পায়। বাইপেলিয়ামের নিঃসৃত পিচ্ছিল রসে শিকার সিক্ত হয়। এরপর মুখছিদ্র দিয়ে ফ্যারিংক্সটি বের হয়ে আসে এবং খাবারটিকে আন্ত্রিক গহ্বরে প্রবেশ করানোর পূর্বেই ছোট ছোট কণায় পরিণত করে।
দেহের এপিথেলিয়ার কোষ অ্যামিবয়েড রীতিতে খাদ্য কণা শোষণ করে ও খাদ্য গহ্বর গঠন করে। ডাইজেস্টিভ এপিথেলিয়াম বা অন্ত্রের শোষণ আবরণীতে এদের খাদ্য সঞ্চিত থাকে। খাদ্য ভক্ষণ না করেই এরা গহ্বরে সঞ্চিত খাদ্যকে কাজে লাগিয়ে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। সঞ্চিত খাদ্যে শেষ হয়ে গেলে বা খাদ্যের অভাব হলে এরা দেহের প্রজনন কলাগুলোকেও কাজে লাগায়।
বাইপেলিয়ামরা সাধারণত রাতেই চলাচল করে। কোনো সাবস্ট্র্যাটামে তথা ভিত্তিতে দেহ নিঃসৃত মিউকাস প্রলেপের উপর দিয়ে এরা ক্রিপিং সোলের সুসজ্জিত সিলিয়ার মাধ্যমে স্বচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারে। প্রাণীটি ভূমি নিকটবর্তী কোনো গাছের উপরও ওঠানামা করতে পারে।
এই চ্যাপ্টাকৃমিগুলো উভয়লিঙ্গের। দেহে দু’টি ডিম্বাশয়, অসংখ্য শুক্রাশয় এবং ভাইটেলাইন গ্রন্থি রয়েছে। কিন্তু কোনো কারণে শরীরের শেষ প্রান্ত কাটা পড়লে বা খণ্ডিত হলে সেই খণ্ড হতে অযৌন পদ্ধতিতে বংশবিস্তার করতে পারে তারা। শরীর খুবই কোমল এবং খুব সহজেই অসংখ্য সক্রিয় খণ্ডে বিভাজিত হয়ে যায়। দেহের পেছনের খণ্ড কোনো ভিত্তির সঙ্গে আটকে পিতৃ দেহটি সরে যায়। শিগগিরই পশ্চাৎখণ্ডটি চলাচলের শক্তি লাভ করে এবং সাত থেকে দশ দিনের মধ্যেই হালকা রঞ্জকযুক্ত মস্তক গঠিত হতে শুরু করে। প্রতি মাসেই এক বা দুইটি খণ্ডক অবমুক্ত হয়। তাই কর্তিত খণ্ড থেকে নতুন অপত্যের জন্ম দেওয়া বৈশিষ্ট্যের কারণে বাইপেলিয়ামদের বিনাসের উদ্দেশ্যে কেঁটে ফেলা উচিত নয় ।
গবেষণাগারে দেখা গেছে, বাইপেলিয়াম তার নিজ দেহের ত্রিশ গুণ ওজনের কেঁচো ভক্ষণে সক্ষম। কেঁচোর ঔদরিক শিকারি হওয়ায় এবং দ্রুত বংশবিস্তারে সক্ষম হওয়ায় এরা কৃষক ও কৃষি কাজের আতঙ্কের কারণ। কেননা মাটিকে আলগা করে বাতাস চলাচল সহজ করার মাধ্যমে জমির উর্বরতা বৃদ্ধিকারী কেঁচোকে এরা খেয়ে ফেলে। কোনো গাছের ক্ষতি বা প্রাণীদেহে কোনো বিষক্রিয়া না ঘটালেও প্রকৃতির লাঙ্গল কেঁচোকে নির্মূল করে এরা দেশের উর্বর জমির জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কেঁচো ও বাইপেলিয়ামের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অন্ধকার পরিবেশ ও আর্দ্রতার মাত্রা একই হওয়ার ফলে এজাতীয় কীট থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। তাই এ জাতীয় বালাই নির্মূলে কৃষককে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এবিষয়ে খুব কম গবেষণা থাকায় প্রাণিবিদ ও কৃষিবিদদের এগিয়ে আসাও জরুরি। দেশের উদীয়মান ভার্মিকম্পোস্টিং তথা কেঁচো চাষ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে ও সামনে এগিয়ে নিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করা আবশ্যক।
লেখক:
মো. মোস্তাফিজুর রহমান, সহকারী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক (রাজশাহী);
সাধারণ সম্পাদক, প্রজন্ম (প্রকৃতির জন্য মমতা); এম.ফিল (ফেলো),
প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
No comments :
Post a Comment