পাতাল নাগিনী
অতি দুর্লভ, সুদর্শন ও রহস্যময় এই সাপটির নামও খুব সুন্দর। ‘পাতাল নাগিনী’। এটি নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার স্থানীয় নাম। সাপটি থাকে নদীর তলদেশে। কিছুক্ষণ পর পর শ্বাস নেওয়ার জন্য সরু মাথা-ঘাড়ের প্রায় ১ ফুট অংশ তীরের ফলার মতো জাগিয়ে দেয় পানির ওপর। খুব সুন্দর দৃশ্য সেটা। চরসিন্দুরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যার জেলেদের কাছে এটা পরিচিত সাপ। দেখুক, না দেখুক, পাতাল নাগিনীর নাম তারা জানে। হিন্দু সম্প্রদায়ের জেলেরা এটিকে পাতালপুরীর পবিত্র সাপ মনে করে। মুসলমান জেলেরা জাল-বড়শিতে পেলে মেরে ফেলে। জেলেরা শীতলক্ষ্যায় রাতের বেলায় নদীর গভীরে পেতে রাখে সারি সারি বড়শি, তাতে টোপ থাকে লাল কেঁচো। ক্বচিৎ পাতাল নাগিনী এসব টোপ গেলে।চরসিন্দুরের সরওয়ার পাঠানের কাছে এই খবরটা শুনে আগ্রহী হই। তাকে বলি একটি নমুনা সংগ্রহ করতে। ১৫ আগস্ট, ২০০৩ সালে বড়শিতে আটকা পড়া একটি সাপ সংগ্রহ করে সে। সাপটি দেখে আমি রোমাঞ্চিত। কিন্তু নানা বইপত্র ঘেঁটেও সাপটিকে শনাক্ত করতে গলদঘর্ম হই। অধ্যাপক কাজী জাকের হোসেন, ড. রেজা খান, ড. রেজাউর রহমানসহ আরও দু-চারজন প্রাণীবিদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমি ও তানভীর খান প্রায় ৯০ শতাংশ নিশ্চিত হই, পাতল নাগিনী বলে পরিচিত এই সাপটির বসবাস সাগরে। এটি মূলত সামুদ্রিক সাপ। কিন্তু এ রকম একটি সাপ স্থায়ীভাবে শীতলক্ষ্যায় থাকবে কেন? ভেবে কূলকিনারা পাই না। ছবি পাঠাই দুবাইতে। ড. রেজা খান আমাদের প্রায় নিশ্চিত ধারাণাকে শতভাগ নিশ্চিত করে জানান, কোনো সন্দেহ নেই এটি সামুদ্রিক সাপই। ইংরেজি নাম Annulated Sea Snak। বৈজ্ঞানিক নাম Hydrophics Cynocinctus। বাংলা নাম ছিটটুল। কালো-হলুদ বলয়যুক্ত লাটিসাপও বলা হয়। হলুদাভ-সবুজ রঙের ওপর কালো কালো চওড়া বলয়। সরু মাথাটা ইংরেজি ‘V’ আকৃতির। স্থলভাগের গোখরার চেয়ে ৮ গুণ শক্তিশালী এদের বিষ। এদের ৩০টি পর্যন্ত বাচ্চা হয়। পাতাল নাগিনী একটানা পাঁচ ঘণ্টা পানির তলায় থাকতে পারে। লেজ চ্যাপ্টা হওয়ায় বৈঠার মতো ব্যবহার করতে পারে। নাকের ওপর আছে স্বয়ংক্রিয় ঢাকনা। মূলত নিশাচর।
হাতে পাওয়া সাপটির লিঙ্গ নির্ণয় করেছিল সরওয়ার পাঠান। মেয়ে সাপ। তানভীরের ধারণা, ওটি ছিল মাঝবয়সী সাপ। লেজসহ সাপটির দৈর্ঘ্য ছিল ৯৬ সেন্টিমিটার। সাধারণত ২০০ সেন্টিমিটার হয়। সরওয়ার সাপটি আগেও দেখেছে। দেখেছে মরা সাপের পেটে থাকা বাচ্চা। সে জানে, সাপটি ডাঙায় এক ঘণ্টার বেশি বাঁচে না। ধরা পড়া সাপটির মাথা থেকে শুরু করে ৩৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত ছিল কালো-হলুদ বলয়। এতেই বোঝা যায়, সাপটি পূর্ণ বয়স্ক নয়। লেজ ছিল ১১ সেন্টিমিটার । মাথা-ঘাড়ের বেড় ছিল তিন সেন্টিমিটার। থুতনি ও গলার নিচে কালো কালো ফোঁটা। পেটের দিকটা দেখতে বেলে মাছের মতো।
বহুকাল থেকে শীতলক্ষ্যায় থাকা পাতাল নাগিনী সাপটি নিয়ে ড. রেজা খান ব্যাপক গবেষণা করতে চেয়েছিলেন। সার কারখানার গরম পানি, অ্যামোনিয়া ও নানা রাসায়নিক বর্জ্য এবং ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্য ইত্যাদিতে অহরহ দূষিত ও বিষাক্ত হচ্ছে শীতলক্ষ্যার পানি। ২০০৪ সালের ২১-২২ মে এ কারণে চরসিন্দুরসংলগ্ন শীতলক্ষ্যা নদীতে মাছের মড়ক লেগেছিল। কোনো পাতাল নাগিনী মরে ভেসে ওঠেনি সেদিন। তবে পাওয়া গিয়েছিল দুর্লভ ও রহস্যময় একটি মাছকে—যেটির নাম ‘বাহক মাছ’। পাতাল নাগিনী ও বাহক মাছ এই দুটি জলজ প্রাণী নিয়ে ব্যাপক গবেষণার সুযোগ রয়েছে। তবে তার আগে বাঁচাতে হবে শীতলক্ষ্যাকে। টিকিয়ে রাখতে হবে পাতাল নাগিনীর খাদ্য বাইম-চিংড়ি ইত্যাদি মাছকে। জানতে হবে, সাগরের সাপ নদীতে কেন? দূষণ সত্ত্বেও শীতলক্ষ্যায় আজও অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে এরা। রহস্য উন্মোচনের দায়িত্ব এখন প্রাণী বিজ্ঞানীদের।
শরীফ খান || প্রথম আলো
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
No comments :
Post a Comment