খাঁড়ির কুমির
বিশ্বব্যাপী কুমিরের মোট ২৭টি প্রজাতি আছে। এদের মধ্যে তিনটি ঘড়িয়াল, মিঠা পানির কুমির ও খাঁড়ির কুমির বাংলাদেশের নদী, খাল-বিলে পাওয়া যেত। ৬০-৭০ বছর আগে মিঠা জলের কুমির ও ৩০ বছর আগে ঘড়িয়াল বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কায়ক্লেশে টিকে আছে শুধু খাঁড়ির কুমির। প্রধানত, পূর্ব সুন্দরবনে। পশ্চিম সুন্দরবনে কুমির খুব কম দেখা যায়। খাঁড়ির কুমিরের যদিও লবণ প্রতিরোধগ্রন্থি আছে, তবু পশ্চিম সুন্দরবনের অতিরিক্ত লবণ কুমিরের সহ্য-সীমার বাইরে।পৃথিবীর তাবৎ কুমির প্রজাতির মধ্যে খাঁড়ির কুমিরই সবচেয়ে বড়। কুমির পৃথিবীতে এসেছে ২০০ মিলিয়ন বছর আগে। এরা যেন প্রাচীন পৃথিবীর ডাইনোসর। এদের বিস্তৃতি ভারতের পূর্ব উপকূল হয়ে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, বোর্নিও, মিন্দানাও, ফিজি হয়ে অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্ব উপকূল পর্যন্ত। তবে এদের বাসস্থানের প্রধান গুণ হতে হবে নদীর মোহনা এবং ম্যানগ্রোভ বন। বিস্তৃতির জন্যই এদের ইংরেজি নাম সল্ট ওয়াটার বা ইস্টুরাইন ক্রোকোডাইল থেকে ইন্দো-প্যাসিফিক ক্রোকোডাইল হয়েছে। বৈজ্ঞানিক নাম Crocodylus porosus.
নীল নদের কুমিরের মানুষখেকো হিসেবে দুর্নাম আছে। কিন্তু ইন্দো-প্যাসিফিক কুমিরের কাছে সেটা কিছুই নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এরা বন এলাকা ছাড়িয়ে খুলনা, বরিশাল জেলার বড়-মাঝারি সব কটি নদীতে আবাস গড়ে তুলেছিল। হিস্ট্রি অব বাকেরগঞ্জ (১৮৭৪) গ্রন্থের লেখক বিভারিজ জানিয়েছেন, এই বর্বরদের উৎপাতে জেলার অধিবাসীরা নদীর পাড়ে স্নান বা ধোয়াধুয়ির কাজ করতে পারত না। বিশেষ করে, মেয়ে ও শিশুরা। স্থানীয় লোকজন গাছের বল্লি পুঁতে নদীতে ঘের দিয়ে স্নানের কাজ সারত। জোয়ারের সময় গরু-বাছুর, মহিষ টেনে নেওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। সরকার বাধ্য হয়ে কুমির মারার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।
১৯৮১ সালে মাস দুই কটকা থাকার সময় কটকা জেটি থেকে দেখতে পেতাম, নদীর পূর্বতীরের চড়ায় একটা বিশাল কুমির ভাটার শুরুতে উঠে থাকত। এটি এত বড় দেখে মনে হতো, একটি ডিঙ্গি নৌকা উপুড় করে রাখা হয়েছে। শীতের দুপুরে বেলা দেড়টা-দুইটার সময় দেখতাম কুমিরটা হাঁ করে আছে। তিনটার দিকে আবার মুখ বোজা। পরে জানতে পেরেছি, অন্যান্য সরীসৃপের মতো কুমিরও তাদের দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ঠান্ডায় কুমিরদের মতো শীতল রক্তের প্রাণীদের কর্মক্ষমতা কমে যায়। ছোট সরীসৃপ বেশির ভাগ শীতনিদ্রায় থাকলেও বড় আকারের সরীসৃপদের সূর্যালোকে গা গরম করে আশপাশের তাপমাত্রার সমতায় আনতে হয়। প্রাণীদেহ যত বড় হবে, তাকে তত বেশিক্ষণ রোদ পোহাতে হবে। পদ্ধতিটিকে বলা হয় ectothermy. শরীর প্রয়োজনের তুলনায় বেশি তপ্ত হয়ে গেলে কুমির হাঁ করে তাপ বের করে দেয়, তবু পানিতে নামে না।
মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে সুন্দরবনের কুমিরের মিলনকাল বলে জানিয়েছেন বন বিভাগের কুমিরগবেষক আবদুর রব। একবার স্থপতি, বলেশ্বর ও ভোলা গাঙের মিলনস্থলে কুমিরের মিলন দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। পাঁচ থেকে ছয় সপ্তাহ গর্ভধারণের পর মা-কুমির ডিম পাড়ে। নদীর ঢালু পাড়ে ঘাস, হুদোপাতা, বিক্ষিপ্ত গোলপাতার মধ্যে জোয়ার সীমানার বাইরে লতাপাতা-ঘাস লেজ দিয়ে লেপ্টে তার ওপর ডিম পাড়ে। অল্প বয়সী মেয়ে কুমির ১০ থেকে ২০টি ডিম পাড়ে। বড় কুমির ৯০-৯৫টি পর্যন্ত ডিম পাড়তে পারে। ডিম পাড়া হয়ে গেলে মা-কুমির ডিমের ওপর বসে পাহারা দেয়। আবহাওয়া গরম থাকলে ৬৭ দিনে, ঠান্ডা পড়লে ১১০ দিনে বাচ্চা ফোটে। ডিম ফাটানোর জন্য বাচ্চার ‘এগটুথ’ বা ‘ডিম দাঁত’ ব্যবহার করে। বাচ্চা হয়ে গেলে কুমির তাদের মুখে করে নদীতে নিয়ে আসে।
ডিমের পরিমাণ মনে রেখে অনেকেরই মনে হতে পারে, সুন্দরবনে ১০টি কুমির ডিম দিতে পারলেই তো বন ভরে উঠবে। কিন্তু প্রকৃতি শিকারি প্রাণীর সংখ্যা নির্ধারণে অত্যন্ত নির্মম। মা-কুমির ডিম রেখে খাবার খোঁজে বাইরে গেলেই গুইসাপ, বানর, শূকর, মেছো বিড়াল ইত্যাদি ডিম খেয়ে ফেলে। বাচ্চা হওয়ার পর, মদনটাক, গ্রে-হেরন, অধিকাংশ ইগল, ফ্যালকন, পাঙাশ মাছ, ভেটকি মাছ, কইভোল মাছ বাচ্চা খেয়ে ফেলে। বাচ্চা এক-দুই বছর হওয়ার পরও তার রেহাই নেই। বড় কুমির স্থানিক প্রাণী। তার এলাকায় বাচ্চা কুমির ঘোরাফেরা করলে সেটাকে পেটে স্থান দেবে। ১০০ ডিমের মধ্যে সাধারণত একটি মাত্র বাচ্চা শেষ পর্যন্ত টিকে যায়। ছোট বাচ্চা, কেঁচো, ফড়িং, চিংড়ি মাছ ইত্যাদি খায়। তিন-চার বছর থেকে মাছ হয়ে ওঠে প্রধান খাদ্য। ইঁদুর, গুইসাপ, ভোঁদড়, বড় সাপ, পাখিও তাদের স্বাভাবিক খাদ্য তালিকায় আছে। বড় কুমির বাগে পেলে হরিণ, শূকর, বানর, জঙ্গলে ভেসে আসা মৃতদেহ খায়। কুমিরের প্রধান অস্ত্র মুখ আর লেজ। হাত-পা অপেক্ষাকৃত দুর্বল। বড় প্রাণীর মাংস ছিঁড়তে হলে কুমিরকে ঝটকা টান এবং ঘূর্ণি পদ্ধতির সাহায্য নিতে হয়। মাংসের চাক কামড়ে ধরে প্রচণ্ড জোরে ঝটকা মেরে মাংস খসিয়ে নেয়। তাতেও যদি খসাতে না পারে, তাহলে চাক কামড়ে ধরে নিজের শরীর দ্রুত ঘোরাতে থাকে। এতে হাড়-মাংস খুলে আসে।
কুমিরের চিবানোর দাঁত নেই। জিবও নেই। তাই খাবার গিলতে হয় সরাসরি।
সুন্দরবনে কমান্ডারের চর, শাপলা, হারবাড়িয়া, ভদ্রা, তিনকোনা, ছিটা ঝটকা, শেলার চর, নীলকমল, কালীর চর এলাকায় কুমির দেখা যায়। বর্তমানে সুন্দরবনে কুমিরের অবস্থা খুব খারাপ। সংখ্যায় ১০০-১২৫টির বেশি হবে না। ক্রমেই বিপন্ন হয়ে পড়ছে এরা।
খসরু চৌধুরী | | প্রথম আলো
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
No comments :
Post a Comment