পাঁতি শিয়াল
পাতি শিয়ালের (Canis aureus) আকার আমাদের পোষা কুকুরের মতোই। লেজটি গুটিয়ে রাখে অর্থাৎ নিচের দিকে নামানো থাকে। গায়ের রং বাদামি, পেছনের অংশে কালো লোম থাকে। এর বেশ কয়েকটি বাংলা আঞ্চলিক নাম আছে যেমন- শিয়াল,(হিয়াল ময়মনশিং, ফেতিয়াল -চাঁদপুর, ,শ্যল- বগুড়া, ফেউ, ফাইত্তাল- ভোলা জেলায় । ইংরেজি নাম Asiatic Jackal ( Canis aureus Linnaeus, 1758) Carnivora বর্গের Canidae গোত্রের প্রাণী পাঁতি শিয়াল ।
পাতি শিয়াল বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ইসরায়েল, মিসর, ইরাক, ইরান, আফ্রিকা,সেনেগাল,মরক্কো,আলজেরিয়া,লিবিয়া,নাইজেরিয়া,তানজানিয়া, ইউরোপ, হাংগেরি,ইউক্রেন, ইটালি, তুর্কি, লেবাননে আছে।
শিয়াল নিশাচর। তবে কখনো খুব সকালেও দেখা যায়। পেটে ক্ষুধা থাকলে দিনের বেলায়ও বের হয়। সন্ধ্যায় শিয়াল ডেকে ওঠে। দিনের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝোপের ভেতর, মাটির গর্তে লুকিয়ে পড়ে। সাধারণত দলে চলে, একাকীও ঘুরতে দেখা যায়। এরা সর্বভূক। প্রধান খাবার পোকামাকড়, পাখি, ছোট আকারের মেরুদণ্ডী প্রাণী, টিকটিকি, মৃতদেহ, শাকসবজি, আখের রস, ভুট্টা ইত্যাদি। খাবারের অভাব দেখা দিলে লোকালয়ে হানা দেয় হাঁস-মুরগি ধরতে।
মেঘলা দিনে বা বৃষ্টির দিনে অনেক পোকামাকড়, ব্যাঙ, ইঁদুর বেরিয়ে এলে শিয়াল খাবারের সন্ধানে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। শীতকালে শরীর গরম করার জন্য এরা ঝোপঝাড়ের নিচে বা ছায়া যুক্ত ঝোপঝাড়ের আড়ালে উঁচু মাটির ঢিপির উপর দল বেঁধে শুয়ে থাকে। সাধারণত একা শিকার করে তবে শিকার যদি বড় হয় সে ক্ষেত্রে দলগত ভাবে শিকার করে। শিয়ালের খাবারের তালিকায় সব ধরনের খাবার আছে যেমন- ইঁদুর জাতীয় প্রাণী, ছাগল, হরিণ, শুকুর, খরগোস, পোকামাকড়, পাখি, সাপ, আঁখের রস, বুনো ফল, কাঁঠাল, তরমুজ, ভুট্টা, মরা প্রাণী, এমনকি কবর খুড়ে মানুষের লাশও পাতি শিয়াল খেয়ে থাকে।
গ্রাম অঞ্চলে তরমুজ,ফুটির ফসলের ক্ষেতে রীতিমত পাহারা বসাতে হয় শিয়ালের উৎপাতের জন্য । আঁখের ক্ষেতে দেখা যায় আঁখের মাঝখানে চিবিয়ে রস খেয়েছে শিয়াল । তাছাড়া আঁখের ক্ষেতের পাশে যেখানে রস জ্বালিয়ে গুড় বানানো হয় , রাতভর দু একটি শিয়াল এসে বসে থাকে জমাট বাঁধা রসের ফেলেদেওয়া মিষ্টি ফেনা খাবার আশায় । গ্রাম অঞ্চলে এমন দৃশ্য আগে প্রায় দেখা যেত ।
অনেক সময় শিয়াল দল থেকে বিতাড়িত হলে বা বড় শিকার দেখলে ফেউ ফেউ শব্দ করে বাঘকে শিকার দেখিয়ে দেয়, অবশিষ্ট খাবার জন্য। তাই শিয়ালের আরেক নাম ফেউ । গল্প কাহিনীতে খলনায়কের গোয়েন্দাকেও তাই হয়ত ফেউ বলে । পাতি শিয়াল নিজ পরিবেশে খাবারের অভাব হলে গৃহস্থের খামারে বা লোকালয়ে চলে আসে। অনেক সময় একা মানুষ পেলে, দল বেঁধে বা একাই আক্রমণ করে বসে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি শিতকাল পাতি শিয়ালের প্রজনন মৌসুম। গর্ভকালীন সময় ৫৮ থেকে ৬৫ দিন । মাটির গর্তে বাচ্চা প্রসব করে। বাচ্চার সংখ্যা ২ থেকে ৮ টি পর্যন্ত হতে পারে। বাচ্চা একটু বড় হলে দুধের পাশাপাশি মা তার বাচ্চার জন্য মুখে করে শিকার নিয়ে আসে আবার আধা হজম খাবার বমি করে বাচ্চাকে খেতে দেয়। ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত বাচ্চা দুধ পান করে। দুধ ছাড়ার পর বাচ্চারা নিজ জীবন শুরু করে। পুরুষ পাতি শিয়াল ১০ মাস বয়সে এবং স্ত্রী পাতি শিয়াল ১৮ মাস বয়সে জনন প্রাপ্ত হয়। পাতি শিয়াল ১২ বছর পর্যন্ত বাঁচে।
সিলেটের মৌলভীবাজার ও বড়লেখায় শিয়ালের ভালোই ডাক শোনা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, বর্ষার সময় মানুষের হাতে শিয়াল মারা পড়ে বেশি। খাবারের জন্য তখন লোকালয়ে আসতেই হয় এদের। আর তখনই মানুষের হাতে নিরীহ এই প্রাণীর মৃত্যু ঘটে।
পাঁতি শিয়াল বাংলাদেশ IUCN ২০০০ এর তালিকা অনুসারে VULNERABLE তালিকাভুক্ত । এবং বাংলাদেশ বনপ্রাণী আইনের CITES- এর দ্বিতীয় পরিশিষ্ট এবং বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ১৯৭৪- এর তৃতীয় তফসিলে অন্তর্ভুক্ত । সুতরাং পাঁতি শিয়াল ধরা বা মারা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। বন্যপ্রাণী রক্ষায় সরকারের কঠোর ব্যবস্থা, বনভূমি রক্ষা, সচেতনতা বাড়ানো এবং জীবপ্রেমই পারে শিয়ালকে বাঁচিয়ে রাখতে।
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
No comments :
Post a Comment