Animals Life in Bengali Description

কমোডিয়ান ড্রাগন

No comments
মোটা, পুরু, চেরা জিভ, চোখে অশুভ, ভয়ানক দৃষ্টি, বড় বড় নখগুলো ধারালো, নয় ফুট লম্বা চকচকে শরীরটা যেন নুড়িপাথরের খোদাই করা। যেন রূপকথার ড্রাগনের জাতভাই। পার্থক্য একটাই- রেগে গেলে এর নাকের ফুটো দিয়ে শুধু আগুনের হলকাটি বেরোয় না! প্রচণ্ড শক্তিশালী এই প্রাণীটিকে একনামে সবাই চেনে কোমোডো দ্বীপের ড্রাগন হিসেবে। আসলে এটি এক জাতের গিরগিটি। তবে পৃথিবীর সবচে’ বড় গিরগিটি, সবচে’ শক্তিশালী এবং সবচে’ হিংস্র। ইন্দোনেশিয়ার কমোডো দ্বীপের এই গিরগিটিরা মানুষের কাছে এখনও এক বিশাল বিস্ময়। এদের বৈজ্ঞানিক নাম ভারানাস কমোডোয়েনিসিস, এক সময় এশিয়া, আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায় বিশালাকার গিরগিটিগুলোর দেখা মিলতো। তবে এদের মধ্যে সবচে’ খ্যাতি লাভ করেছে ইন্দোনেশিয়ার কোমোডো দ্বীপের গিরগিটিরা। এই বড় আকৃতির গিরগিটিরা গুই সাপ নামে পরিচিত গ্রমাঞ্চলে।
ফসিল বা জীবাশ্ম থেকে পাওয়া সূত্রে জানা যায়, বিশালদেহী এই সরীসৃপদের পঞ্চাশ বা ষাট মিলিয়ন বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার বিবর্তন ঘটেছে। ওই সময় কমোডো, রিনৎজা, পাডার বা ফ্লোরেস দ্বীপের একাংশ, যা বর্তমানে এই গিরগিটিদের আবাসস্থল, তার অস্তিত্ব ছিলো না। এই দ্বীপগুলোর সৃষ্টি হয়েছে অগ্নুৎপাত থেকে। এই ড্রাগনরা কী করে উত্তর পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া থেকে ৫০০ মাইল দূরের এই দ্বীপগুলোতে চলে এল, সেটা বিস্ময়করই বটে। কারণ ভারানাস কমোডোয়েনিসিসরা সাঁতারু হিসেবে তেমন দক্ষ নয়, লেসার সুন্ডাসের (ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপ) প্রবল ঘূর্ণিস্রোতের বিরুদ্ধে টিকে থাকার রেকর্ড এদের খুবই কম।

তবে ধারণা করা হয়, এই স্রোতই কোমোডো ড্রাগনদের বাঁচিয়ে রেখেছে। কারণ খুব কম জেলেরই বুকের পাটা আছে ওই ভয়ানক স্রোত পার হয়ে দ্বীপে ওঠার। জেলেরা গণহারে দ্বীপে যেতে পারলে ড্রাগনদের ঝাড়বংশ এতোদিনে নিকেশ হয়ে যেত। 
১৯১২ সালে লোকে প্রথম কোমোডো দ্বীপের ড্রাগন সম্পর্কে জানতে পারে জাভার বোগের-এর জ্যুলজিক্যাল মিউজিয়ামের পরিচালক, মেজর পি-এ ওয়েনস-এর মাধ্যমে। ওই সময় এই ড্রাগনদের নিয়ে একটি আর্টিকেল লেখেন তিনি। বলা যায়, তারপর থেকে মানুষ প্রাচীন সময়ের এই সরীসৃপ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে এবং তাদের রক্ষার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। শুরুতে তথ্যানুসন্ধানকারীরা কোমোডো এবং তার আশপাশের দ্বীপ থেকে এই প্রজাতিগুলোকে ধরে নিয়ে যেত চিড়িয়াখানার জন্যে। তখন বিশালদেহী গিরগিটিগুলোর শরীরের আকারই তাদের আগ্রহের প্রধান কারণ ছিল, এদের আচার-আচরণ বা প্রকৃতি নিয়ে গবেষণামূলক কার্যক্রম তেমন ছিল না। প্রকৃতিবিদ ডব্লিউ ডগলাস বার্ডেন প্রথম ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় এই গিরগিটি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ছাপেন এবং ‘ড্রাগন’ নামটিও তিনিই প্রথম ব্যবহার করেন।
কোমোডো দ্বীপের ড্রাগনদের টিকে থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, এদের কোন বিশালদেহী প্রতিদ্বন্দী নেই। এরা যে এতো মোটা, তাজা এবং প্রকাণ্ডদেহী এর কারণ এরা প্রচুর খায়। পঁচা-গলা মাংস তাদের প্রিয় খাদ্য। মৃত ছাগল, বুনো শুয়োর, হরিণ-বা ওয়াটার বাফেলো’র মাংস খেয়েই এরা বেঁচে আছে। তবে মৃত প্রাণী দিয়েই বেশি উদর পূর্তি করে থাকে কোমোডো ড্রাগন, জ্যান্ত প্রাণীর ওপর এদের হামলার ঘটনা ক্বচিৎ ঘটে।
বয়সে তরুণ ড্রাগনরা ভয়ানক ক্ষিপ্রগতি সম্পন্ন, অন্যান্য গিরগিটিদের মতো তারাও গাছ বাইতে পটু। এরও পঁচা-গলা শবদেহ গিয়ে পেট ভরায় তবে খুব পছন্দ করে গেকো, (এক ধরনের টিকটিকি) সাপ এবং পাখির ডিম। প্রাপ্তবয়স্ক ড্রাগন আবার একটু আলসে স্বভাবের, নড়াচড়া করে কম। সুযোগ পেলে তবেই শিকার-টিকার ধরে।

ইন্দোনেশিয়ায় কোমোডো ড্রাগনকে বলা হয় ‘বুয়াজা ডারাট’ বা জমিনের কুমির। এর সুযোগ পেলেই গৃহস্থের পোষা ছাগলের ওপর হামলা চালিয়ে বসে। রিনৎজা দ্বীপের এমন অনেক ছাগলের গায়েই এই আঁচড়ের দাগ আছে, ড্রাগনের থাবা থেকে যারা পালিয়ে বেঁচেছে।

ড্রাগনগুলো এক লাফে বড় জোর পাঁচ ফুট দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। অবশ্য সাবধানী মানুষ যারা তাদের এদেরকে ভয় পাবার কিছুই নেই। কারণ দৌড়ে ড্রাগনগুলো তাদের সঙ্গে পারবে না। তবে রীসাস বানর (উত্তর ভারতের খুদে বানর) এবং টাট্টু ঘোড়াদের বাগে পেলে খেয়ে ফেলার অবাক করা দৃষ্টান্তও তৈরি করেছে পূর্ণবয়স্ক এই ড্রাগন। 

কোমোডো ড্রাগনরা কিন্তু বন্দীদশা মোটেও পছন্দ করে না। তাই তাদের ধরা সম্পূর্ণ নিষেধ বলেই ঘোষণা করেছে ইন্দোনেশিয়ার সরকার। ’৬৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার বাইরের চিড়িয়াখানাগুলোতে সাকুল্যে আটটি কোমোডো ড্রাগন ছিলো। এখন সম্ভবত একটিও নেই। ইন্দোনেশিয়ার সরকার রিনৎজা দ্বীপকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে। ওখান থেকে ড্রাগন ধরা বা বাইরে রপ্তানি করা এখন সম্পূর্ণ নিষেধ।

কোমোডো ড্রাগনের গড় আয়ু বিশ বছর। তবে এদের প্রজনন প্রক্রিয়া এখনও অজ্ঞাত। সাধারণত আট থেকে নয় ফুট লম্বা হলেও ১৯৩৩ সালে সেণ্ড লুই চিড়িয়াখানায় ১০ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা একটি ড্রাগনের কথা জানা যায়। ওজন ছিল ৩৬৫ পাউণ্ড। সম্ভবত সেটাই এ যাবৎকালের সবচে বড় গিরিগিটি।

কোমোডো ড্রাগন আবার বেশ পেটুক স্বভাবের। এদের খাওয়ার দৃশ্যটিও দেখার মতো। বলা হয়, লম্বা চেরা জিভ দিয়ে এরা খাবারের গন্ধ শুঁকে নেয়। এদের দাঁত করাতের মত ধারালো, শক্তিশালী চোয়ালে চেপে ধরে শিকারের গোটা শরীর ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। হাড়, চুল, নাড়িভুঁড়ি সবই খেয়ে ফেলে, কিছুই বাদ দেয় না।

ম্যানহাটন শহরের দশগুণ বড়, ইন্দোনেশিয়ার কোমোডো দ্বীপ সমুদ্র সমতল থেকে ২০০০ ফুট উঁচুতে, লম্বায় ২২ মাইল। চওড়ায় ১২ মাইল। আকৃতি অনেকটা কুড়ালের মতো। এ দ্বীপে রয়েছে ঘাসে মোড়া ঢাল সেখানে হাজারো গোখরো, ভাইপার, বিষাক্ত বিছে আর মাকড়সার বাস। গোটা দ্বীপে ছড়িয়ে আছে বিশাল সব আগ্নেয়গিরি। পাহাড়ের নিচে, সাগরে সবসময় খিদে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় হিংস্র হাঙর। আছে বিরাট সামুদ্রিক সাপ, যেগুলোর কামড় কোবরার মতই ভয়ানক। সব মিলে অত্যন্ত দুর্গম দ্বীপ কোমোডো। এ দ্বীপের রাজা হলো এই ড্রাগন। বিশাল দেহের কারণে এরা কাউকেই পরোয়া করে না। রাজার হালে ঘুরে বেড়ায়। মাটি খুঁড়ে গর্ত করে। সেখানে গ্রীষ্ম এবং বর্ষা ঋতুটা কাটিয়ে দেয়। বৃষ্টি বা বন্যার সময় গর্ত পানিতে ভরে গেলে আরও উঁচু জায়গা বেছে নেয় আস্তানার জন্যে। এ সময় সাধারণত পাহাড়ের গুহাই তাদের সবচে পছন্দ। আর খরা হলে গুহা ছেড়ে নদী তীরের গর্তে গিয়ে ঢোকে একটু আরাম পাবার আশায়।

বর্তমানে শুধু ইন্দোনেশিয়ার চারটি দ্বীপেই এই সরীসৃপদের বাস। সংখ্যায় হাজারের বেশি হবে না। বিরল এই প্রাণীগুলোর অস্তিত্ব এখন সাংঘাতিক বিপন্ন। চোরা শিকারীরা এসব দ্বীপের হরিণ শিকার করে ড্রাগনদের তীব্র খাদ্য সংকট সৃষ্টি করছে। মানুষের গৃহপালিত ছাগল দ্বীপের ঘাস খেয়ে সাবাড় করছে। ঘাস না থাকলে হরিণ এবং ওয়াটার বাফেলো’রা খাবে কি? তারা তখন দ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হবে। তখন খাদ্যভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে ওদের। কাজেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের এই জীবদের বাঁচা-মরা বর্তমানে নির্ভর করছে মানুষের ওপরেই।

No comments :

Post a Comment