শজারু
সজারু। শরীরে কাঁটাওয়ালা এ এক অদ্ভুত-দর্শন প্রাণী। স্বাধীনতার আগপর্যন্ত বাংলাদেশের অনেক গ্রামেই এরা টিকে ছিল। এখন আর আছে বলে মনে হয় না। দেশের শালবনগুলোর কোনো কোনোটিতে টিকে আছে বলে জানা যায়। গারো পাহাড়শ্রেণীসহ বৃহত্তর সিলেট-চট্টগ্রামের টিলা-পাহাড়ি বন তথা প্রাকৃতিক বনে টিকে আছে।গর্তজীবী ও নিশাচর এ প্রাণীটিকে দেখার আগে আমি ওদের শরীরের ঝরে পড়া কাঁটা দেখেছিলাম আমাদের বাগানটিতে। কুড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। প্রাণীটিকে দেখার আগে অবশ্য সন্ধ্যার পরে ওদের কাঁটার ঝুমঝুম বাজনা বহুবার শুনেছি ঘরে শুয়ে। সন্ধ্যার বেশ কিছু পরে ওরা বাগান থেকে বেরিয়ে উঠান-বাড়ি পাড়ি দিয়ে মাঠের দিকে যেত। কুকুরেরা হাঁকডাক করে ধাওয়া দিলে ওরা শরীরের কাঁটা ফুলিয়ে-দুলিয়ে দৌড় দিত। তখন শব্দ বাজত। পাশের গ্রামের মুচিরা এক দিন দড়ির জাল-ফাঁদ নিয়ে আমাদের গ্রামে এল। একটি বাগান ঘেরাও দিল। সঙ্গে ছিল ওদেরই দু-তিনটি কুকুর। বহু মানুষ জড়ো হলো। ওদের জালে সেবার পড়ল পাঁচটি শজারু। তার ভেতর তিনটিই পিচ্চি ছানা। ওই-ই প্রথম দেখলাম। আমার শৈশবে।
আমাদের এলাকা বাগেরহাটের ফকিরহাটের অনেক বাগান ও ভিটার ঝোপঝাড়ে ছিল ওরা। শজারু নিজেরাই মাটিতে গর্ত করে। দু-চারটি মুখ থাকে। মুচিরা প্রতিবছর আসত। গর্তে আগুনের ধোঁয়া দিয়ে জাল পেতে শিকার করত। লাঠি-বল্লমও ব্যবহার করত। শজারুর কাঁটা মেয়েরা চুলের খোঁপায় গুঁজত। তখনি শুনেছিলাম এ কাঁটার ব্যবহার হতো এককালে পাঠশালায়, হ্যান্ডেল বা কঞ্চির কলমের বিকল্প হিসেবে।
শজারু নিরীহ প্রাণী। তবে, প্রয়োজনে দুঃসাহসী ও কুশলী। আক্রান্ত হলে এরা শরীরের ধারালো কাঁটা ফুলিয়ে একেবারে বল্লমের মতো খাড়া করে শত্রুর দিকে পেছন ফিরে তেড়ে যায়। শত্রু—এমনকি বাঘ-চিতাবাঘ-মেছোবাঘ-পাতিশিয়ালেরাও এই আক্রমণে হটে যায়। কেননা, এ কাঁটার ডগা খাঁজকাটা, শরীরে ঢুকলে খোলা বড়ই দুঃসাধ্য, বড়ই যন্ত্রণাদায়ক। পচন ধরে।
এদের মূল খাদ্য মানকচু-কপি-আলু-বাঁশের কোঁড়ল, শাকসবজি, বিভিন্ন শস্যদানা। মাটিতে ঝরে পড়া বিভিন্ন ফলও তারা খায়। সামনে পেলে যেকোনো মৃত পাখি বা প্রাণীর হাড্ডিগুড্ডি, গরু-মোষ-ছাগলের শিংও খায় চিবিয়ে খায়। এদের শরীরের কাঁটা ঝরে পড়ে, আবারও গজায়। ভয় পেলে বা কাউকে ভয় দেখাতে এরা শরীরের কাঁটায় দুই-তিন রকমের শব্দ তুলতে পারে। শক্তিশালী পা ও নখর এদের। তাই নিজেরাই গর্ত খুঁড়ে মাটির তলায় নির্মাণ করে সুরক্ষিত দুর্গ।
এদের বাচ্চারা চোখ খোলা অবস্থাতেই জন্মায়। একবারে বাচ্চা হয় দু-তিনটি। দেখতে যা সুন্দর না! জন্মের সময় শরীরে কাঁটা থাকে নরম। দুই সপ্তাহ পরে শক্ত হয়। এদের ইংরেজি নাম Indian crested porcupine। বৈজ্ঞানিক নাম Hystricx indica। শরীরের মাপ লেজসহ ৮৫-৯০ সেন্টিমিটার। ওজন ১৫-২০ কেজি। বড় কাঁটার মাপ হয় ২২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত।
আবাসভূমির সংকট ও মাংসের জন্য শিকারই এদের গ্রামবাংলা থেকে নিশ্চিহ্ন করেছে। অথচ এরা আমাদের প্রকৃতির আবশ্যিক অনুষঙ্গ ও সৌন্দর্য।
শরীফ খান | প্রথম আলো
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
No comments :
Post a Comment