কেউটে সাপ
বাংলাদেশের বনজঙ্গল, বাগবাগিচা, বিল-ঝিল, গ্রাম এমনকি শহরেও গোখরো প্রজাতির দুটো উপপ্রজাতি দেখতে পাওয়া যায়। সাপুড়েদের কল্যাণে পদ্মগোখরো বা খরিশ সাপটি প্রায় সবাই চেনে। সাপুড়েদের কাছেই আরেকটি গোখরো অনেকেই দেখে থাকবে। সাপুড়েরা একে কেউটে বা কালিগোখরো নামে পরিচিত করায়। কেউটে পদ্মগোখরোর মতোই ফণা তোলা সাপ। তবে এর ফণা পদ্মগোখরোর মতো অতটা চওড়া নয়। কেউটে দেখতে অনেক গাঢ় বর্ণের। ফণায় পদ্মগোখরোর যেমন সাদাটে ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের মতো দাগ রয়েছে, কেউটের ফণায় ইংরেজি ‘ও’ অক্ষরের মতো দাগ রয়েছে।পদ্মগোখরো শুকনো এলাকা পছন্দ করে। পুরোনো বাড়িঘর, উইয়ের ঢিবি, ইটের পাঁজা, মাটির ঘরে ইঁদুরের গর্ত গোখরোর পছন্দের জায়গা। কেউটে জলার ধার বা ভেজা এলাকা পছন্দ করে। এ জন্য দক্ষিণ বাংলায় কেউটের প্রাদুর্ভাব বেশি।
ফণায় অলংকরণের বৈচিত্র্য, নির্মোক ছাড়ানোর পর বর্ণবাহার, বাদামি হলদে থেকে কুচকুচে কালো রঙের হওয়ায় কেউটের প্রচুর নাম বাংলা-ইংরেজি ভাষায় পাওয়া যায়। চলতি ইংরেজি নাম মনোসিলেট কোবরা। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজ আমলাদের বর্ণনায় ‘কোবরা ডি কোপোলো’ বা ‘বেঙ্গল কোবরা’ হিসেবে কেউটের উল্লেখ পাওয়া যায়। গত শতাব্দীর ষাটের দশক পর্যন্ত ইংরেজ বা আধখেঁচড়া বাঙালি সাহেবরা বুটের ওপর পট্টি পরতেন পদ্মগোখরো ও কেউটের কামড় সামলাতে।
কেউটের বাংলা নাম নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে যথাক্রমে হানক, পানাস ও আলোদ। যশোর-খুলনায় বলা হয় পদ্মকেউটে, আলকেউটে, কালকেউটে, বাঁশবুনে কেউটে ইত্যাদি। অনেক সাপবিজ্ঞানী কালাজ সাপকে (krait) কেউটে বলে উল্লেখ করেছেন ভুল করে।
সুন্দরবনে কেউটে বহুবার দেখেছি। এগুলো ভিন্ন প্রজাতির কি না জানি না। ছোট থেকে বড়—এদের সবারই রং গাঢ় বাদামি অথবা কালো। ফণার নিচে একটি বা পাশাপাশি দুটি সাদা বলয় আছে। কোনো কোনো সাপের সারা দেহেই খানিক দূরত্ব রেখে অস্পষ্ট আঁশের বলয় দেখা যায়। কেউটে লম্বায় গোখরোর চেয়ে সামান্য বড় হয়। এদের ল্যাটিন নাম Naja kaouthia নেওয়া হয়েছে সম্ভবত কেউটে নাম থেকে।
জঙ্গল ও হোগলা, নলখাগড়ার জলাভূমি থাকলেই সেখানে কেউটে সাপ আবাস করে নেবে। অন্যান্য সব সাপের মতো কেউটেও জ্যান্ত প্রাণী খায়। ছোট স্তন্যপায়ী, পাখি, ডিম, সাপ, ব্যাঙ, মুরগির ছানা, মাছ, কীট-পতঙ্গও কেউটের খাদ্যতালিকায় রয়েছে। তবে শীতল রক্তের মাছ ও ব্যাঙ কেউটে খুব ক্ষুধার্ত না হলে ধরে না।
অন্যান্য ইলাপিডি গোত্রের (বাংলায় চৌসাপা গোত্র) প্রজাতিগুলোর মতো কেউটের বিষদাঁতও সামনের দিকে অবস্থিত। আকারে ছোট অনেকটা কুলের কাঁটার মতো ভেতরের দিকে বাঁকানো। দাঁতের সামনের দিক নালিকাটা। এই নালি বিষথলির সঙ্গে যুক্ত। কেউটে ঘাপটি মেরে, কখনো তাড়িয়ে শিকার ধরে। কেউটের মারাত্মক মারণ বিষে প্রায় ১২টি এনজাইম (দেহকোষের জৈব রাসায়নিক পদার্থবিশেষ) রয়েছে। ছোট শিকার কেউটে কামড়ে ধরে রাখে, কম ক্ষেত্রে পেঁচিয়ে ধরে। বিষের তীব্রতা এত বেশি যে ছোট স্তন্যপায়ী তিন-চার মিনিটে অবশ হয়ে যায়। তবে ব্যাঙ মারতে সময় লাগে।
কেউটে নিশাচর সাপ হলেও মেঘলা দিনে খাবারের খোঁজে বের হয়ে পড়ে। ছোট কেউটে সাপখেকো ইগলের হাতে ধরা পড়লেও বড় আকারের কেউটেকে কেউ ঘাঁটাতে চায় না। গরমের সময় মার্চ থেকে জুলাই মাস কেউটে ডিম পাড়া ও বাচ্চা তোলায় ব্যয় করে।
কেউটের বিষ মানুষের জন্য প্রাণঘাতী। কামড়ের সঙ্গে সঙ্গে দংশিত স্থানে ভয়ঙ্কর জ্বালাপোড়া হয়। বিষ স্নায়ুবিধ্বংসী বলে মাংসপেশি, হূদযন্ত্রের সঞ্চালন ক্রিয়া অবশ করে দেয়। ফলে মানুষের ঠোঁট, চোখের তলা, হাত-পা ঝুলে পড়ে। অ্যান্টিভেনিন চিকিৎসা না হলে বিষ ঢোকার পরিমাণ অনুযায়ী এক থেকে তিন ঘণ্টায় রোগী মারা যেতে পারে।
বিষধর সাপ কাউকে কামড়ালে তাকে নির্বিষ করতে সাপুড়ে কোনো কাজে আসে না। দেশে সর্পাঘাতে মৃত্যুর একটা বড় অংশের জন্য দায়ী কেউটে। সুন্দরবন কেউটে সাপের আড়ত। অথচ সেখানে কেউটের হাতে মৃত্যুর হার অত্যন্ত কম। প্রকৃত পক্ষে বন্যার সময় বাস্তু হারিয়ে কেউটে মানুষের ঘরে আশ্রয় নেয়। তখনই দংশনের ঘটনা বাড়ে।
**খসরু চৌধুরী**
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
No comments :
Post a Comment